সসেমিরা — নাবিল মুহতাসিম

বাজারে বা পথেঘাটে তাকে দেখলে দুইবার ফিরে চাইবেন না আপনি। অতি সাধারণ চেহারা—মাথার চুল কাকের বাসা, আধভাঙা গালে সাতদিনের না-কামানো দাড়ি, রোদেপোড়া চামড়া নিশ্চয়ই সারা দিন বাইরে ঘোরার ফল, কালচে ঠোঁট দেখে বোঝা যাচ্ছে সিগারেটপ্রীতিটা অতিরিক্ত। একহারা গড়ন, সাড়ে পাঁচ ফিটের একটু বেশি লম্বা। পৌরবাজারে মাছ কেনার সময় বা শ্যামপুর স্টেশনের ভিড়ে এই লোক আপনার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও টের পাবেন না। খালি চোখটা বাদে। ওই তীক্ষ্ণ ছুরির মতো নজর যেন ভেতরটা দেখে ফেলে। এমন চোখের সামনে ন্যাংটো মনে হয় নিজেকে।

এভাবেই দৃশ্যপটে প্রথম প্রবেশ করে নাবিল মুহতাসিমের ডিটেকটিভ ‘টিকটিকি’ কামাল। শার্লকের মতো অবজারভেশন ক্ষমতা দিয়ে মানুষকে চমকে দেবার ঝোঁক বাদ দিলে ডিটেকটিভ হিসেবে কামালের মতো ইউনিক ক্যারেক্টারাইজেশন আর দেখিনি!

কামাল ইন্সপেক্টর রইসের একজন সোর্স বা ইনফরমার। সে প্রচণ্ড বই পোকা—সারাদিন সস্তা স্মার্টফোনে পিডিএফ পড়ছে। উত্তরবঙ্গের চলিত ভাষা ব্যতীত তাকে কথা বলতে শোনা যায়নি। কিন্তু তাবৎ বিষয় সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল সে, এলাকার কোনো খবর তার অজানা নয়। একটা ক্লোজ-নিট-কম্যুনিটিতে যাওবা গোপনীয়তা থাকার কথা সেটাও কামালের নখদর্পনে রয়েছে। এমন একজন স্ট্রিট-স্মার্ট লোকের অনুসন্ধিৎসু মন থাকা বা গ্রে-সেলের সার্থক প্রয়োগ করতে পারা ব্যাপারটা সেন্স-মেক করে। এই বিচারে কামাল একজন খুবই খুউল ড্যুড—আমার ভীষণ পচ্ছন্দ হয়েছে, মনে দাগ কেটেছে।

সামগ্রিকভাবে সসেমিরা এমনই এক সম্পূর্ন ভিন্ন ধারার ডিটেকটিভ থ্রিলার। সসেমিরার আভিধানিক অর্থ কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তবে এর পৌরাণিক ব্যাপ্তি ভিন্ন। আমার মনে হয়েছে উপন্যাস সসেমিরা সেরকম লার্জার দ্যান লাইফ একটা মাত্রা এনেছে। ডিটেকটিভ উপন্যাসের সীমানা ভেঙ্গেচুরে একাকার করে দিয়েছে। পৌরাণিক সসেমিরার সাথে যে সাদৃশ্য টানা হয়েছে কামালের চিত্রায়ণে তার আবেদন অসামান্য।

গড়পড়তা ডিটেকটিভ উপন্যাসের কমন ট্রোপগুলোও সার্থকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রধান চরিত্রের থট-প্রসেসে আমাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, বিশেষ করে ১৭তম অধ্যায়ে। সত্যেন্দ্রনাথের ছিন্নমুকুলকে যেভাবে সাংকেতিক ভাষায় ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে তা অতুলনীয়।

২য় চ্যাপ্টার আমার সবথেকে বেশি ভালো লেগেছে! এটা যে কোনো সুস্থ মানুষের মনে ভয় ধরিয়ে দিতে বাধ্য। এই ডিটেইলিংকেই আমি লেখকের ব্রক্ষাস্ত্র ধারণা করি। হোক সেটা ক্যারেক্টারাইজেশনে, গল্পের বুননে কিংবা আবহ, পরিবেশ বর্ণনাতে—মাত্রাছাড়া স্বতঃস্ফূর্ত উনি। আমার জানা নেই উনাকে কেউ আগে বলেছেন কিনা বা উনার কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা তবে আমার বৌ আর আমি, আমাদের নিজস্ব আলাপে কনভিন্সড যে উনি চমৎকার ফ্যান্টাসি লিখতে পারবেন। উনার নিজস্ব পৃথিবী তৈরির সাংঘাতিক ক্ষমতা আছে।

কিছু অতি-নাটকীয় ব্যাপারও যে নেই তা বলবোনা, স্পেশালি নায়কের মার খেয়ে ভর্তা হয়ে যাবার পর কাহিনী ব্যাখ্যা করা, লায়লার সাথে এলাবোরেটেড সিক্যুয়েন্সটা। তবে সেগুলো ধারণা করি পরিমিত মশলা, যার অপব্যবহার হবেনা ভবিষ্যতে।

নোলানের টেনেটের সাথে একটা আনক্যানি রিজেম্‌ব্লেন্স আছে শেষ দৃশ্য সহ, অ্যাবিউসিভ হাসব্যান্ডের পাওয়ারপ্লের দিক থেকে! যদিও সেটা শুধুমাত্র একটা যৎসামান্য মিল ছাড়া আর কিছুনা।

বেশ কিছু অমীমাংসিত ব্যাপার আছে, বিশেষ করে কামালের ব্যাকস্টোরি। আশা করছি টিকটিকি কামালকে নিয়ে ভবিষ্যতে আরও কাজ হবে। আমার পড়তে দারুণ লাগবে।

বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন পার্থপ্রতিম দাস, উপন্যাসের সাথে দারুণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে। নজরকাড়া, ভিন্নধর্মী টাইপোগ্রাফি যা পৌরাণিক ভাবসহ গল্পের সাথে দারুণভাবে ম্যাচ করেছে।

বইয়ের ফ্ল্যাপটাও চমৎকারভাবে লেখা, গল্পের পাশাপাশি কীর্তিমারি জেলা শহরে যে ইনভিটেশন দেওয়া হয়েছে তা অগ্রাহ্য করা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে!

অবসরের বইগুলোর ব্যাপারে একটা কথা না বললেই না, বানান ভুলের পরিমাণ নগণ্য। কাগজ, বাঁধাই এগুলোও দারুণ। তবে আমার বইটার হার্ডকভারটা জুতের না, একটু পড়তে গিয়েই বেঁকে গেছে।

বই : সসেমিরা
লেখক : নাবিল মুহতাসিম
প্রকাশনা : অবসর প্রকাশনা সংস্থা
প্রকাশকাল : ২০২১
প্রচ্ছদ : পার্থপ্রতিম দাস
পৃষ্ঠাসংখ্যা : ১৫৯
মলাট মূল্য : ৩০০

Leave a Reply