দ্য মেইডেনস — অ্যালেক্স মাইকেলিডিস | মো. ফুয়াদ আল ফিদাহ

আলোচনা করেছি মূল কাহিনী—ঠিক কী হলো, কীভাবে হলো—সেসব। এ আলাপকে বলা যেতে পারে ‘সহজ ভাষায় দ্য মেইডেনস’। নিজস্ব একটা উন্মত্ত তত্ত্ব বা পরিসমাপ্তিও জুড়ে দিয়েছি সাথে! সুতরাং বইটা পড়া না থাকলে দূরে থাকাই শ্রেয়।

স্পয়লার অ্যালার্ট

১.

উপন্যাসে তাহলে কী হলো? খুনির মতলব কী ছিল? সে মোতাবেক পরিকল্পনা কী ছিল?

বইয়ের শেষে দেখানো হলো সব খুন জোয়ি করেছে। তবে সমস্ত পরিকল্পনা সেবাস্টিয়ানের। মূলত সম্পত্তির লোভে মারিয়ানাকে বিয়ে করেছিলো সেবাস্টিয়ান। জোয়ির বয়স যখন ১৫, তখন থেকেই সেবাস্টিয়ানের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার সে। এর জের ধরে তাদের মধ্যে একটা অসুস্থ সম্পর্ক চলতে থাকে। জোয়ির ভাষ্যে, সম্পত্তি ও জোয়ির মাঝে পথের কাটা ছিল মারিয়ানা। তাই মারিয়ানাকে সরিয়ে দেবার বিশদ ও অব্যর্থ পরিকল্পনা করে সেবাস্টিয়ান!

পরিকল্পনাটা ছিল এরকম — মেইডেনদের মধ্যে প্রথমে টারাকে খুন করা হবে। জোয়ি এরপরে মারিয়ানাকে জানাবে তার ভয়ের কথা। উস্কে যাওয়া মারিয়ানা তখন তার স্বভাবগত কাছিমের কামড়ের মতো ফস্কার পেছনে লাগবে। আরও মেইডেনকে খুন করে এটাকে সিরিয়াল কিলিংয়ে রূপ দেওয়া হবে। জোয়ি খুনের কিছু আলামত ফস্কার ঘরে রেখে আসবে। এদিকে মারিয়ানাকেও একই উপায়ে খুন করা হবে। ফস্কা মাঝখান থেকে ফেঁসে যাবে। দিনশেষে সকল সম্পত্তি হাতিয়ে নেবে জোয়ি ও সেবাস্টিয়ান।

কিন্তু সকল পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিলো মারিয়ানার নাক্সোস ভ্রমণ। নিরুপায় সেবাস্টিয়ান ভ্রমণে সঙ্গী হয়ে দুর্ঘটনায় নিজের জীবনটাই খোয়ালো। এদিকে রাগে-শোকে অন্ধ জোয়ি, সেবাস্টিয়ানের মৃত্যুর জন্য মারিয়ানাকে দায়ী করে। এরপরে একাই পরিকল্পনামাফিক সবকিছু করতে থাকে। জোয়ির এটা সেবাস্টিয়ানের স্মৃতির প্রতি এক প্রকার শ্রদ্ধা নিবেদন ও মারিয়ানার প্রতি প্রতিশোধ।

* অর্থলোভী সেবাস্টিয়ান — এই যুক্তিতে দুর্বলতা আছে। সেটা পরে উল্লেখ করা হবে।

* অর্থই প্রধান চালিকাশক্তি হলে ধারণা করি, সেবাস্টিয়ান সবকিছুর পরে জোয়িকেও মেরে ফেলতো।

২.

সেবাস্টিয়ান ও জোয়িকে খলনায়ক হিসেবে দেখানো হয়েছে। প্রশ্ন হলো এটা কি ধুপ করে আকাশ থেকে ফেলা সমাপ্তি হয়ে গেল কিনা? উপন্যাসে কি আগে থেকে এ ব্যাপারে কোনো সূত্র বা ইঙ্গিত ছিল? আমার কাছে যেগুলো ইঙ্গিত বলে মনে হয়েছে তা তালিকাভুক্ত করছি। শক্ত না দুর্বল ইঙ্গিত সেটা আলোচনা-সাপেক্ষ!

সূত্র ও ইঙ্গিত

ক) সবচেয়ে বড় ইঙ্গিত ছিল মারিয়ানা ও রুথের আলাপে। মারিয়ানাকে তার বাবার ব্যাপারে একচোখা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সতর্ক করে রুথ। বাবার বিভিন্ন বিষয়ে মারিয়ানা অন্ধ, একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত বুঝতেই পারেনি আপত্তিজনক ব্যবহার। তেমনই সেবাস্টিয়ানের ব্যাপারেও মারিয়ানার একই দৃষ্টিভঙ্গি।

বইয়ের ৪র্থ অংশের ভূমিকাতে অ্যালিস মিলারের একটি উদ্ধৃতি আছে। শৈশবের অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি হলে মানুষ সতর্ক হতে পারে না। পিতার মতো আচরণ কেউ করলে নিজের অজান্তেই তার বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। এই বিচারে, সেবাস্টিয়ানের ব্যাপারে সতর্ক হবার ইঙ্গিত ছিল বইয়ে।

খ) আরেকটা বড় ইঙ্গিত ছিল সেবাস্টিয়ান প্রসঙ্গে মারিয়ানার বাবার প্রতিক্রিয়া। সেবাস্টিয়ানকে অর্থলোভী ভেবেছিলেন মারিয়ানার বাবা। এমনকি সেবাস্টিয়ানকে বিয়ে করলে সম্পত্তি থেকে ত্যাজ্য পর্যন্ত করবার হুমকি দিয়েছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে এটাকে মারিয়ানার বাবার দুর্ব্যবহার হিসেবে মনে হলেও, এটা আসলে মেয়ের প্রতি ভালোবাসা থেকেই করেছিলেন। সেবাস্টিয়ান সম্পর্কে মারিয়ানা যা বুঝতে পারেনি, তার বাবা ঠিকই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন।

গ) নিজের বাবা-মার সাথে সেবাস্টিয়ানের দূরত্বের প্রসঙ্গ এসেছে। তারা তাকে ভালোভাবে জীবন শুরু করতে সাহায্য করেনি। এ প্রসঙ্গে অর্থের আলাপ এসেছে আবারও। সেবাস্টিয়ানের অর্থের প্রতি ভালোলাগা বা চাহিদা তুলে ধরা হয়েছে।

কিন্তু সেবাস্টিয়ানকে অর্থলোভী দেখানোর সমস্যা হলো—যে ব্যক্তি অর্থের জন্যই সবকিছু করবে সে তাহলে মারিয়ানাকে বিয়েই বা কেন করবে। সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করবার হুমকিই তো দিয়েছিলেন মারিয়ানার বাবা। উনি যে মত পরিবর্তন করবেন সেটা অনুমান করা তো সম্ভব নয়। মারিয়ানার বাবাকে খুন করবার স্পষ্ট কারণ আছে। সেবাস্টিয়ান ও জোয়িকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলেছিলেন তিনি। সুতরাং খুন করতে হবে। মৃত্যুর পরে জানা গেলো মারিয়ানা সকল সম্পত্তির মালিক। কিন্তু খুন করার পূর্বে এই তথ্য তো কারোরই জানা ছিল না।

ঘ) মারিয়ানা প্রায়ই সন্দেহ করেছে জোয়ি কিছু লুকাচ্ছে। জোয়িকে ঠিকমতো বুঝতে পারছে না সে। যদিও এটা নিয়ে খুব বেশি চাপাচাপি সে করেনি। কিন্তু এটা একটা ইঙ্গিত। জোয়ির ভাষ্য সন্দেহজনক ছিল।

ঙ) জোয়ি বারবার মারিয়ানাকে উস্কে দিচ্ছিল সেবাস্টিয়ানের প্রসঙ্গ এনে। সেবাস্টিয়ান থাকলে অন্যরকম কিছু করতো—এটা বলে মারিয়ানাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ধান্দাবাজি করছিলো বলে মনে হয়েছে।

চ) জোয়ি প্রসঙ্গে এলসি জানিয়েছে তার সঙ্গে নির্দয় ব্যবহারের কথা। মারিয়ানা এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে একপ্রকার উড়িয়ে দিয়েছে, উল্টা এলসিকে উন্মাদ প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে। যদিও, মারিয়ানার প্রতি এলসির ব্যবহার দেখলে তাকে একদমই এমন উন্মাদ বলে মনে হয় না।

ছ) বইয়ে ফ্রেড ও তার ভবিষ্যৎ দেখার বিষয়টা অনেকক্ষণ ধরে জিইয়ে রাখা হয়েছে। যদিও সেটা দুর্বল দিক এবং কিছুটা হাস্যকর। সে হিসেবে জাদুকরী বা কুসংস্কারাচ্ছন্ন আবহে মারিয়ানার প্রার্থনাকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ডিমেটার ও পার্সেফোনির কাছে মারিয়ানা প্রার্থনা করে সুখ-সমৃদ্ধির জন্য। সেবাস্টিয়ান তাতে মারা যায়। পরের দিকে আবারও প্রার্থনা করলে চিঠিটা হাতে পড়ে। যদিও মারিয়ানা ভেবেছিল, দেবীরা রুষ্ট হয়ে সেবাস্টিয়ানকে কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যায়ে এসে আমরা বুঝতে পারি, আসলে সেবাস্টিয়ানের হাত থেকে দেবীরা তাকে বাঁচিয়েছে।

৩.

আমার একটা উন্মত্ত তত্ত্ব আছে—সেবাস্টিয়ানের মৃত্যুর পেছনে আসলে মারিয়ানার হাত রয়েছে। সে কোনোভাবে ভাগ্নি জোয়ির সাথে সেবাস্টিয়ানের অবৈধ সম্পর্কের কথা জেনে ফেলেছিল। এরপরে নাক্সোসে খুন করে তাকে। দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয় সেটাকে। এক বছর ধরে নিজের সেই খুনি স্বত্বাকে অস্বীকার করে গেছে মারিয়ানা। পরিশেষে সে নিজের মুখোমুখি হতে পেরেছে। খুনি স্বত্বাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এরকম উড়াধুরা সমাপ্তি দেখালেও সেটা মারিয়ানা চরিত্রের যে মানসিক ব্যবচ্ছেদ ও রূপান্তর, তার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হতো না!

যাইহোক, আরও কোনো সূত্র যদি থাকে, অনুগ্রহ করে জানাবেন। বইয়ের সমাপ্তি কেমন লাগলো সেটাও জানাবেন।

বই : দ্য মেইডেনস
লেখক : অ্যালেক্স মাইকেলিডিস | মো. ফুয়াদ আল ফিদাহ
প্রকাশনা : ভূমিপ্রকাশ
প্রকাশকাল : ২০২১
প্রচ্ছদ : সজল চৌধুরী
পৃষ্ঠাসংখ্যা : ৩২০
মলাট মূল্য : ৪৯০

Leave a Reply