ধাঁধার থেকেও জটিল — নিয়াজ মেহেদী

বাঙলা সাহিত্যের মৃত্যুঘন্টা বেজে গেছে।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) “শব্দজব্দ” কীভাবে সাহিত্য রচনা করছে? কিংবা, আজিজ মার্কেটের তেরোতলায় নকশালবাদী তিন তরুণের লাশের সাথে শব্দজব্দের সম্পর্ক কী? ধাঁধাটা আসলে এর মধ্যে কোনটা? কেনইবা সেটা জটিল?

ধাঁধার থেকেও জটিল পড়ে আমার অনুভূতি মিশ্র। একদিকে যেমন চমৎকার রচনাশৈলীর গুণে মুগ্ধ হয়েছি। আবার মনঃক্ষুণ্ণও হয়েছি নানাবিধ কারণে। বিশেষ করে অসমাপ্ত পরিসমাপ্তির কারণে, যেন শেষ হইয়াও হইল না শেষ!

উপন্যাসের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক এর লেখার ভঙ্গিমা, রেটরিক। এমন প্রাঞ্জল ভাষা, শুধু পড়তেই ইচ্ছে করে। নকশালবাদ থেকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, খুনের রহস্য থেকে সার্থক লেখার ইন্ট্রোস্পেক্ট—সব দিকেই যাদুকরী অন্তর্দৃষ্টি প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয়। সাব-প্লটগুলোর মধ্যে গোলাম গাউসের অংশটা পাঠক-লেখক সবার কাছে সমাদৃত হবেই হবে।

এআই প্রসঙ্গের প্রকট উপস্থিতি থাকলেও মনে রাখতে হবে এটা কিন্তু কোনো সাই-ফাই উপন্যাস নয়। লেখকের অ্যাপ্রোচকে আমি স্যাল্যুট জানাই। এই সূত্রে বলা যায়, কার্ট কোবেইনকে স্টাডি করে এআই নির্ভানার ফেইক গান বানিয়ে ফেলেছে, সুতরাং বিষয়টা এগজিস্ট করে। একেবারে গাঁজাখুরি গপ্প নয়।

যাইহোক, লেখকের সব লেখা দ্রুত পড়ে ফেলার তাড়না অনুভব করছি। এই বইটাও সবার অন্তত একবার পড়া উচিৎ। শুধুমাত্র থ্রিলার হিসেবে পড়লে আশাহত হতে হবে এই আরকি!

স্পয়লার সেকশনে কিছু অদ্ভুত, অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে আলোকপাত করছি।

স্পয়লার অ্যালার্ট

ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়না, নভেলিস্ট-এআই এর বিপরীতে মানুষের সংগ্রামকে গ্লোরিফাই করে কিছু লিখলে সেটা আদপেও কিছু হতো। কিংবা এআই টেক-অভার করছে সবকিছু, এটাও হতো ক্লিশে। এআই আসলে শুভঙ্করের ফাঁকি, এটাই ভালো ব্যাখ্যা।

কিন্তু সমস্যাটা হলো থ্রিলার অংশের ট্রিটমেন্টে! বুঝলাম এআই বনাম মানুষের যুদ্ধ মুখ্য করা যাবেনা। কিন্তু তাই বলে, আউট অব নোহয়ার, ধৃতি!

প্রথমত, তিন জন কমরেডকে খুন করার ব্যাপারে ওর মোটিভেশনই পরিষ্কার না। আবার সে ঠিকঠিক জামিরদার বাসায় যায়। সেখানেও তার মনের মধ্যে কু ডাক দিলো। বুঝে গেলো আজ কিছু হতে চলেছে, ঘুমানো যাবে না! এদিকে সিএনজি ড্রাইভারইবা কেন পুলিশকে জানাবে! ড্রপ করার সময় তো সে গরীবের সেন্টিমেন্ট কার্ড প্লে করলো! এগুলো বিশাল বড় কাকতাল।

আর জামিরদার সমস্যাই বা কী! দলের তিন জন উচ্চ পর্যায়ের কর্মী খুন হয়েছে। কিন্তু সে ব্যাপারে উনার কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। এখন, সেই খুনের সূত্র ধরে ধৃতি মারফত উনার পর্যন্ত পুলিশ পৌঁছে যেতে পারে বিধায় ধৃতিকে খুন! এ কেমনতর এসকেলেটেড ভাবনাচিন্তার সন্নিবেশ!

এবার আসা যাক, ইমরানের ব্যাপারে! পুরো বইতেই টিজ করা হয়েছে নাহিদার সাথে তার চাপা উত্তেজনার ব্যাপার। সুতরাং, শেষমেশ নাহিদার সাথে তার পরিণয় কোনো চমক নয়। কিন্তু তার এআই-এর বিপরীতে লড়াই করার পুরো আর্কটার কী হলো তাহলে! গোলাম গাউসের সাথে এই চরিত্রের যে দার্শনিক আলোচনা, একেবারেই অপ্রয়োজনীয় ব্যাপার হয়ে গেলো কিনা! এই পুরো জিনিসটাকে যথাযথভাবে অ্যাড্রেস করা হয়েছে বলে মনে হয় না। শেষদিকে এসে, যন্ত্রের সাথে সহাবস্থানের ইঙ্গিত দেওয়াটাই ইনাফ না।

আমার মনে হয়, এই জিনিসগুলো আরেকটু সময় নিয়ে উপস্থাপন করলে অভিযোগ তোলার কোনো সুযোগই থাকতো না। শেষের দিকে, তাড়াহুড়ো করে একটা যবনিকা টানার চেষ্টা হয়েছে। পুরো বইতে, লেখার গুণে প্রত্যাশার পারদ যেই তুঙ্গে উঠছিল সেটাকে কেমন যেন এক নিমিষেই শেষ করে দেওয়া হলো। গল্পের ছাড়া সুতোগুলোকে ঠিকমত গুছিয়ে আনা হলো না। পুরোপুরি তৃপ্ত হবার আশাপ্রদ যে আকাঙ্ক্ষা, তা অপূর্ণই রয়ে গেলো।

বই : ধাঁধার থেকেও জটিল
লেখক : নিয়াজ মেহেদী
প্রকাশনা : অবসর প্রকাশনা সংস্থা
প্রকাশকাল : ২০২১
প্রচ্ছদ : পার্থপ্রতিম দাস
পৃষ্ঠাসংখ্যা : ১৩৯
মলাট মূল্য : ২৫০

Leave a Reply