একজোড়া চোখ খোঁজে আরেকজোড়া চোখকে — জাহিদ হোসেন

সৃষ্টির শুরু ত্রীৎ দিয়ে, সৃষ্টির শেষেও ত্রীৎ। ত্রীৎ ছিল, ত্রীৎ আছে, ত্রীৎ থাকবে…

‘লভক্রাফটিয়ান হরর’ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে জাহিদ হোসেন লিখেছেন ভিন্নধর্মী নভেলা ‘একজোড়া চোখ খোঁজে আরেকজোড়া চোখকে’। কেন ভিন্নধর্মী সে প্রসঙ্গে আসছি একটু পরেই।

জাহিদ হোসেনের লেখা আমার বরাবরই ভালো লাগে। ডার্ক হিউমর, বোল্ড ডায়ালগ, গা-গুলানো ভিসারাল বিবরণ, পপ কালচার রেফারেন্স—এসবই উনার সিগনেচার এলিমেন্ট। স্বাভাবিকভাবেই এর সবই এখানেও বিদ্যমান।

বইয়ের দুর্দান্ত প্রচ্ছদটি করেছেন ডিলান। গল্পের সাথে চমৎকারভাবে মিলেছে।

নভেলাটির মূল গল্প মফস্বলের বস্তিতে গা ঢাকা দেয়া লেখক আসগর আলীকে কেন্দ্র করে। একদিন চায়ের দোকানে সাচ্চুর কাছে অদ্ভুত এক গল্প শোনেন তিনি। পরে সেই গল্পের সুলুক-সন্ধানে পরাবাস্তব এক অভিযানে বেরিয়ে পড়েন। সঙ্গী হন রেহমান সিদ্দিক ও তার বোন।

আগের অনুচ্ছেদে, আসগর আলীর গল্পকে যদিও মূল গল্প বলছি। কিন্তু এই গল্পের ভিত্তি আরও ৪টি গল্প। মোট ৫টি অতিপ্রাকৃত গল্প বলা হয় পুরো বইয়ে—আপাত দৃষ্টিতে সম্পর্কহীন। কিন্তু আসলে এগুলো সবই কানেক্টেড।

স্পয়লার সেকশনে বইটাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। আশাকরি, পাঠকের প্রশ্নগুলোর সহজবোধ্য উত্তর পাওয়া যাবে।

স্পয়লার অ্যালার্ট

★ মূল যে হরর এলিমেন্ট ত্রীৎ, সে বহু প্রাচীন। সৃষ্টির শুরু থেকে আছে, হয়তোবা মানুষেরও আগ থেকে। এই ব্যাপারটা প্রতিষ্ঠা করার জন্য ইথিওপিয়ার লালিবেলার কাহিনী বা মহেঞ্জোদারো আধ-ভাঙ্গা পানপাত্র ভূমিকা রেখেছে।

★ বাকী ৪টা গল্পকে ট্রু-স্টোরি বেইজড ফ্যাক্টস্‌ হিসেবে উত্থাপন করা হয়েছে। এগুলো অবশ্যই ট্রু-স্টোরি, কিন্তু সেটা আমাদের পরিচিত পৃথিবীতে না। বরং জাহিদ হোসেন যে ইউনিভার্স সৃষ্টি করেছেন সেখানে।

★ সাধারণত, অন্যান্য বইয়ে এরকম তথ্য বদল হয় চরিত্রগুলোর আলাপে। কিন্তু এখানে আলাদা গল্পের মাধ্যমে ফাইন্ডিংস আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই অ্যাপ্রোচটা আকর্ষণীয়।

★ গল্পগুলোতে লকেট বা কয়েনের উপস্থিতি অর্থবহ। যেমন : নাতাশার সাথে যৌন মিলনে ত্রীৎ হবে এটা ওর লকেটে ছিল। রাহেলার লকেট ইমপ্লাই করে রূপান্তরিত ত্রীৎ-এর কথা। এই ব্যাখ্যাটা প্রফেসর স্পাইকও দিয়েছেন।

★ মজার বিষয় হল, গল্পে ‘দু’চোখে সর্বগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে’ তাকানো জাহিদ নামের একজন চরিত্র আছে! এটা কি লেখক জাহিদ? এই প্রসঙ্গে বইয়ের একটা লাইন উল্লেখ করতে চাই, “সব মানুষই কম বেশি কামুক, ভদ্রতার মুখোশ লাগিয়ে ঘোরে।” জব্বর বলেছেন বটে!

★ গল্পে রেহমান সিদ্দিক যে বই লেখেন শেষ দিকে, সেটাই আসলে আমরা উপন্যাস আকারে পড়ছি! আসগর আলীও একটা বই লিখতে চেয়েছিলেন, যার শুরু হবে একটা কবিতা দিয়ে, শেষও হবে একই কবিতা দিয়ে। আমরা যে বই পড়ছি সেটা শুরু হয় ত্রীৎ কবিতা বা শ্লোক দিয়ে। শেষ হয় ‘একজোড়া চোখ খোঁজে আরেকজোড়া চোখকে’ কবিতা দিয়ে। ইতোমধ্যে পাঠক বুঝে যাবেন পরেরটা ত্রীৎ শ্লোকেরই বঙ্গানুবাদ! একই ভাবে ফাইন্ডিংস আকারে আসা গল্পগুলো রেহমান সিদ্দিকের এতো বছরের গবেষণালব্ধ জ্ঞান। উনি যে নন-ফিকশন লিখতে গিয়ে প্রেমের ফিকশন গল্প লিখে ফেলেন বইয়ে, সেই ছাপই কিন্তু পাওয়া যায় মূল উপন্যাসে! এভাবেই বই ও তার বাস্তবতা মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।

★ লভক্রাফটিয়ান জনরার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, কসমিক এন্টিটির তুলনায় মানুষ খুবই ক্ষুদ্র। মানুষের পক্ষে এদের বিরুদ্ধে কোনোভাবেই জেতা সম্ভব না। পরিণতিটা কিছুটা বিলম্ব করতে পারে সর্বোচ্চ। এখানেও রেহমান সিদ্দিক ফাইনালি তার এই অসহায়ত্বই স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। ত্রীৎ রয়ে গেলো, সরাসরি ওদের সংস্পর্শে আসলেন, তার লেখা বই ওরা নিয়ে গেলো!

★ অমীমাংসিত যে ব্যাপারটা রয়ে যায়, আসগর সাহেব যে কবিতাটা বহু বছর আগেই লিখেছেন, সেটা ত্রীৎ-এর শ্লোক! উনি কীভাবে এতো আগে তা লিখতে পেরেছিলেন? আমার ধারণা, অনেক আগে থেকেই ত্রীৎ-রা তার উপরে নজর রেখেছে, যোগাযোগ করেছে। আসগর সাহেব হয়তো সাব-কনশাসলি এই শ্লোকের অনুবাদ করে ফেলেছেন। এজন্যই প্রথমবার গুহায় ত্রীৎ উনাকে পালিয়ে যেতে দেয়, অদ্ভুতভাবে তাকায়। যদিও আসগর সাহেবের বীর্যই কেন লাগবে, সেটা পরিষ্কার না। ত্রীৎ-এর সিলেকশন প্রসেস আমরা জানিনা।

বই : একজোড়া চোখ খোঁজে আরেকজোড়া চোখকে
লেখক : জাহিদ হোসেন
প্রকাশনা : বাতিঘর প্রকাশনী
প্রকাশকাল : ২০১৮
প্রচ্ছদ : ডিলান
পৃষ্ঠাসংখ্যা : ৯৬
মলাট মূল্য : ১৪০

Leave a Reply