মায়াবনবিহারিণী হরিণী — কিশোর পাশা ইমন

জিনিয়া, আমার বউ, আর আমি যেকোনো বই সাধারণত কাছাকাছি সময়ে পড়ি। এতে আমাদের নিজেদের আলোচনা করতে সুবিধা হয়। সেরকমই এক আলোচনায় আমরা আবিষ্কার করলাম, গড়পড়তা জনরা স্পেসিফিক লেখার আবেদন আমার কাছে আর তেমন নেই!

এখনই রেগেমেগে আমাকে তুলোধুনো করতে ছুটবেন না, একটু ধৈর্য ধরুন। ফিকশন হোক বা নন-ফিকশন, প্রচুর পরিমাণে ক্রাইম ঘরানার জিনিস কঞ্জিউম করেছি। এ অবস্থায়, শুধু একটা রগরগে থ্রিলার দিয়ে চমকে দেওয়াটা খুব কঠিন। আমি মনে করি, ক্রস-জনরা এখানে একটা সেইফ বেট। আর যদি জিনিসটা পার্ফেক্টলি ব্লেন্ড করে, তার আবেদন হবে কমপ্লিটলি ডিফরেন্ট লেভেলে। ক্রস-জনরার প্রোজ-অ্যান্ড-কনস্‌ বিচার করতে চাই না, রিস্ক বেশি হলেও আমি এই দিক ঘেঁষা।

মায়াবনবিহারিণী হরিণী মোটামুটি দুই-বসায় পড়ে শেষ করেছি গত মাসের ২৫ তারিখে। জিনিয়াকে জানালাম, ভীষণ ইম্প্রেসড হয়েছি। এই রকম বইয়ের ব্যাপারেই ঐ আলোচনায় করছিলাম আমরা। ২৬ তারিখের মধ্যেই পাঠ-প্রতিক্রিয়া লিখে রেখেছিলাম। এরপরে অনুভূতি থিতু হবার জন্য যথেষ্ট সময় দিলাম। এতদিন পরেও, আগের বক্তব্যের বিপরীতে যেতে পারলাম না। আমি জানি না আর কেউ এরকম ফিল করেছেন কিনা। আমাদের নিজস্ব আলাপে এই বিষয়টা উঠে আসলো।

মায়াবনবিহারিনী হরিণী, এই ভাবনার সাথে পার্ফেক্টলি অ্যালাইন করে। এটা জাস্ট একটা ক্রাইম-থ্রিলার বই না। রহস্য সমাধান করা এর একমাত্র উদ্দেশ্য না, তারচেয়েও বেশি কিছু। সিমিলার স্যাটিসফ্যাকশন পেয়েছি সসেমিরা পড়তে গিয়ে, সেটা ভিন্ন আলোচনা যদিও।

মায়াবনবিহারিণী হরিণীর গল্প মেঘনার তীরে এক কলোনি আঁকড়ে। এই কলোনি আমাদের টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করে। এখানেই হুট করে, আলোচিত ৩ সুন্দরীর একজন গায়েব হয়। পরিস্থিতির ফেরে তরুণ ডাক্তার মিথুন ফেলুদার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। রহস্য দানা বাঁধে, প্রচুর জল ঘোলা হয়।

প্রথমদিকে গল্পের ন্যারেশনে আগাথা ক্রিস্টি ভাইব আছে। হুডানিট-ভাবে কাহিনী আগাতে থাকলেও, কে অপরাধী বুঝে ফেললেও তেমন ইমপ্যাক্ট পড়বে না। টুইস্ট দেওয়াটা বইয়ের একদমই উদ্দেশ্য না।

চমকপ্রদভাবে ইনভেস্টিগেটিভ-ওয়েতে কাহিনী আগাতে থাকে। পরিশেষে একটা প্রপার সমাপ্তি পাওয়া যায়। খুবই সেলফ-কনটেন্ট একটা ফিলিংস আসে। এটা শুধুমাত্র ১ম লেয়ারের স্বাদ আস্বাদন হলো। পরের লেয়ারটা, এবং আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, অপরাধের যেই কার্যকারণ খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে সেটা অনুধাবন করা। লেখকের বক্তব্য লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার। বিভিন্ন চরিত্র, বিশেষ করে রাহাত রহমানের মায়ের বক্তব্যের মাধ্যমে লেখক তার অবস্থান পরিষ্কার করেছেন।

গল্পের কলোনি, আবহ, পরিবেশ, সামাজিক চিত্র—এরা নিজেরাই সামগ্রিকভাবে একটা চরিত্র হয়ে উঠেছে। এদের যে সার্থক উপস্থাপন সেটা বাদ দিয়ে এই কাহিনীর কোনো সমাপ্তি আনা সম্ভব ছিল না।

সব চরিত্রের সংলাপ শতভাগ রিলেটেবল, আউট-অব-ক্যারেক্টার তেমন কোনো সংলাপ নেই। সংলাপগুলো যেন জীবন্ত, তাদের নিজেদেরই আলাদা প্রাণ আছে—এটা এই বইয়ের মূল চালিকাশক্তি। জিনিসটা বইয়ে আনা খুব টাফ, প্রপ্স্‌ টু দ্য রাইটার।

অনেকেই লেখকের এক্সপ্লিসিট সেক্স সিনের ডিটেইল্ড রাইটিং নিয়ে আলোচনা করেন। কিন্তু আমি মনে করি উনার এক্সেলেন্স ডিস্টার্বিং সিক্যুয়েন্স বর্ণনায়—আনলেস অফকোর্স কেউ সেক্সকে ডিস্টার্বিং হিসেবে ইনক্লুড না করলে—হোক সেটা গোরি কমব্যাট সিকুয়্যেন্স বা খুন কিংবা জখমের বর্ণনা। জাদুঘরে যেমন সমস্ত সংযম শিকেয় তুলেছেন এখানেও তেমনই গা গুলানো, ভিসারাল (পেট গুড়গুড়) রাইট-আপস্‌ আছে।

লেখকের মিথস্ক্রিয়া, চাহিদারা হন্যে, জাদুঘর ১ম পত্র পড়া আছে। আমার কাছে কমপ্লিট অ্যান্ড মোস্ট ইফেক্টিভ কাজ মনে হয়েছে মায়াবনবিহারিণী হরিণী।

আবারও, অবসর-এর প্রোডাকশন টপ ক্লাস। লেখকের অন্যান্য বইয়ের তুলনায় বানান ভুল নেগ্লিজিবল। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, ফেসবুকিয় ‘দিসে, করসে’ বইয়ের পাতায় দেখতে একদমই ভালো লাগে না।

প্রচ্ছদে সম্ভবত থ্রিলার না বরং আরবান-ড্রামা ভাবটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কেন যেন বইয়ের কোয়ালিটির সাথে আপটু-দ্য-মার্ক মনে হয়নি।

বই : মায়াবনবিহারিণী হরিণী
লেখক : কিশোর পাশা ইমন
প্রকাশনা : অবসর প্রকাশনা সংস্থা
প্রকাশকাল : ২০২১
প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ
পৃষ্ঠাসংখ্যা : ১৬০
মলাট মূল্য : ৩০০

Leave a Reply