নৈর্ঋত — জাহিদ হোসেন

কালেভদ্রে কোনো লেখা আমাদের নাড়িয়ে দিয়ে যায়। কারণ, ব্যক্তিবিশেষে স্বতন্ত্র রুচিকে সব লেখা ছুঁতে পারে না। আমার ক্ষেত্রে জাহিদ হোসেন ব্যতিক্রম, তাঁর সব লেখা বরাবরই ভালো লাগে। পড়াটা উপভোগ করি—একই ভাষায় কথা বলি আমরা, তরঙ্গ দৈর্ঘ্য একই।

গল্পের শুরু খণ্ডবিখণ্ড লাশ দিয়ে। পরিপাটি করে কেটে ট্যাগ করা, হাতের সাথে লেখা হাত, পায়ের সাথে পা। সাথে ২৯টি লেজবিহীন টিকটিকি ও চিরকুট। ছোট্ট চিরকুটে লেখা: লিজার্ড কিং ফিরে এসেছে।

নৈর্ঋত উৎসর্গ করা হয়েছে তিন গোয়েন্দা ও রকিব হাসানকে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্ররা কিশোর-কিশোরী, এদের চোখেই আমরা নৈর্ঋতের পৃথিবী দেখি। রহস্য উদঘাটনে তাদের ভূমিকা সক্রিয়। বুঝাই যাচ্ছে তিন গোয়েন্দাকে হোমেজ দিয়েছেন লেখক। 

আশার কথা হচ্ছে, এটা ঠিকঠাক হোমেজই, শ্রদ্ধাঞ্জলি দেবার নামে কমপ্লিট রিপ-অফ না।

প্রধান চরিত্ররা কিশোর-কিশোরী হলেও এটা কিশোর উপন্যাস নয়—গল্পবলিয়ে, সংলাপে কোনো পর্দা নেই, একদম র। কিশোর বয়সে একজন যেভাবে দুনিয়া দেখে, বন্ধুমহলে কথা বলে—ঠিক সেটাই, কোনো রাখঢাক ছাড়াই লেখায় এসেছে। আনসেন্সরড গালাগালি, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি মনোভাব, বয়ঃসন্ধিকালীন মেজাজ, রাগারাগি, নোংরা কৌতুক—দেদারছে রয়েছে সবকিছু।

রহস্য সমাধানে তদন্ত প্রয়োজন। আর তদন্তের প্রতি ধাপে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত হালনাগাদ করতে হয়। বাস্তবে এমন হয় না যে, কেসের সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্ত সূত্র বা সঠিক দিকনির্দেশনা শুরু থেকেই মেলে। বরং, তথ্য নয়েজ আকারে থাকে, ভিড় থেকে সেগুলো আলাদা করতে হয়।

বিশেষ করে মিথলজির ইন্টারপ্রিটেশন ব্যক্তি বা সোর্সের পারসেপশনের উপরে অনেকাংশে নির্ভরশীল। নৈর্ঋতে গ্রীক মিথের ভিন্ন ইন্টারপ্রিটেশন দাঁড়া করানো হয়েছে। যেমন: প্যান্ডোরার বাক্সের বিভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ধাপে ধাপে, ব্যক্তিবিশেষে সম্পূর্ন আলাদা।

এই যে, কোনো অবস্থাতেই স্পষ্ট কারণ বা নিশ্চিত ব্যাখ্যা পাচ্ছে না পাঠক, এটা আমার খুবই বাস্তবসম্মত লেগেছে—ঋদ্ধ করেছে পাঠ-অভিজ্ঞতাকে। মগজাস্ত্র ব্যবহার করতে খানিকটা বাধ্য করেছে।

তিন গোয়েন্দার পাশাপাশি নাইন্টিজের নানা বিষয়কে রোমান্টিসাইজ করেছেন লেখক। সেবা প্রকাশনী, টেনিদা, ঘনাদা, ফেলুদা ঘুরেফিরে এসেছে। তখনকার ক্রিকেট উন্মাদনার সার্থক চিত্রায়ন দেখতে পাই। সেসময় বেড়ে ওঠা মানুষের জন্য বইটা টাইম ট্রাভেলিং ডিভাইস হতে পারে—নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়েছি বারংবার। ঠিক কী কী রেফারেন্স আছে তা উল্লেখ করে আপনার পাঠ অভিজ্ঞতা নষ্ট করতে চাচ্ছি না। দেখে নেবেন কতো কতো ইস্টার এগস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রক মিউজিকের বহুল ব্যবহার মুগ্ধ করেছে একইভাবে। 

নৈর্ঋতকে পরিচয় দেয়া হয়েছে হরর-ফ্যান্টাসি হিসেবে। আমার কাছে আরও অনেককিছুর ক্রস-জনরা মনে হয়েছে। বিশেষ করে মিথলজির উপর্যুপরি ব্যবহার। সুপারন্যাচারাল এলিমেন্টটা পড়ে মনে হয় ক্রস-রোড ডিমন! শুরুর দিকে হরর আবহটা দুর্দান্ত, লিজার্ড কিংয়ের উত্থান প্রফেসি আতঙ্ক ধরিয়ে দেয়। তবে, শেষ দৃশ্যে এই হররের ম্যানিফেস্টেশন স্তিমিত। সারা বই জুড়ে যে বিভীষিকার প্রতিশ্রুতি দেখি তাঁর রূপায়ন যথাযথ মনে হয়নি। 

এই প্রসঙ্গে বলা দরকার, লেখকের অন্যান্য বইয়ের মতো এটাও একটা বিয়োগান্তক উপন্যাস। যে মানসিক বিক্ষোভের মধ্যে দিয়ে চরিত্রদের যেতে হয় সেটাই চরম বিভীষিকাময়।

চূড়ান্ত যুদ্ধটাও বিশাল কলেবলের তুলনায় কিছুটা পানসে। রেভেলেশনগুলোর প্লেসিং ঠিক যুতসই হয়নি। যে বিশাল ধাক্কাটা খাবার কথা ছিল সেটা শক্তিশালী হয়নি শুধুমাত্র আগেই সাবপ্লটের উন্মোচনের কারণে।

নৈর্ঋত আসলে একটা প্রেমের উপন্যাস! ভালোবাসার অসুস্থ পর্যায়কে ফ্যান্টাসির ছাঁচে ফেলে উপস্থাপন করেছেন লেখক। যদিও ‘সুস্থ’ ভালোবাসার নিদর্শনও আমরা পাই। বন্ধুত্ব-প্রেমের জয়গান পাওয়া যায় নানা জায়গায়।

বইয়ের অসাধারণ প্রচ্ছদ করেছেন মাহাতাব রশীদ, মনে হয় না এর চেয়ে ভালোভাবে প্রেজেন্ট করা যেতো। ভেতরে ওয়াসিফ নূরের দারুণ কিছু অলঙ্করণ আছে, বেশিরভাগই অর্থবহ। কয়েকটাতে যদিও সাবজেক্ট ও পারিপার্শ্বিক আবহের অনুপাত মেলে না গল্পের বর্ণনার সাথে। তবে সবমিলিয়ে এই ইলাস্ট্রেশনগুলো চমৎকার লেগেছে।

প্রতীক প্রকাশনীর বইয়ে সাধারণত তেমন মুদ্রণ প্রমাদ পাওয়া যায় না। নৈর্ঋত-এর মতো বিশাল বইয়ের তুলনায় আসলেও এগুলো কম। তবে হ্যাঁ, বেশ কিছু ‘র’ ও ‘ড়’ বিভ্রাট পাওয়া যায়। যেমন: গৌরচন্দ্রিকা এর জায়গায় গৌড়চন্দ্রিকা। বেশ কিছু জায়গায় অবাঞ্ছিত অসমাপিকা ক্রিয়ার ব্যবহার চোখে পড়ে। এছাড়া সম্পাদনার সাংঘাতিক ভুল পেয়েছি এক জায়গায়, বিশেষ এক চরিত্রের ট্রান্সফর্মেশনের সময় নাম বিভ্রাটে।

কাজের চাপে নৈর্ঋত পড়েছি দফায় দফায় বসে। সাধারণত আমি একটানা পড়ে ফেলি। আশ্চর্যজনকভাবে খেয়াল করলাম, নৈর্ঋত সময় নিয়ে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার মতোই বই। স্বভাবতই, বিশাল কলেবর একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। এছাড়াও, এত এত চরিত্র, পাতায় পাতায় এতকিছু হচ্ছে সেটা আস্তে-ধীরে পড়লে সম্ভবত সবচেয়ে বেশী এঞ্জয় করা যাবে। বিশেষ করে নাইন্টিজের মানুষজনের জন্য, স্মৃতি-রোমন্থন যদি করতে হয় আরকি।

বহুল প্রতীক্ষিত বই হিসেবে নৈর্ঋত কি প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে? এক শব্দে, হ্যাঁ। জাহিদ হোসেনের ফ্যানদের জন্য একটা ট্রিট এটা। এমনকি যারা অভিযোগ করেন তাঁর বইয়ের এন্ডিং ভালো হয় না, তারাও সম্ভবত বেটার কিছু পাবেন। আপনাদের পাঠ প্রতিক্রিয়া অবশ্যই জানাবেন, শুভকামনা।

বই : নৈর্ঋত
লেখক : জাহিদ হোসেন
প্রকাশনা : প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা
প্রকাশকাল : ২০২২
প্রচ্ছদ : মাহাতাব রশীদ
পৃষ্ঠাসংখ্যা : ৫২০
মলাট মূল্য : ৭০০

Leave a Reply